নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ই অক্টোবর ২০২৫, ১৯:২১
আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি এক সপ্তাহের সফরে ভারতে পৌঁছেছেন, একসময় যা ছিল কল্পনাতীত।
২০২১ সালে পশ্চিমা মদদপুষ্ট আশরাফ গনি সরকারকে হটিয়ে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর এটাই তাদের সবচেয়ে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধির প্রথম ভারত সফর। আট দিনের সফরে মুত্তাকি দেশটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবেন।
এ সফরকে ভারতের আফগান নীতি জোরদার করার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করার পর নয়াদিল্লি ঘোষণা করেছে, তারা কাবুলে তাদের দূতাবাস আবার খুলবে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর চার বছর আগে ভারত দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছিল।
ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তানের ঐতিহাসিকভাবে তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দেশটি এবারের ঘটনাবলির দিকে নিবিড় নজর রাখবে।
জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা থেকে সাময়িক ছাড় পেয়ে মুত্তাকি রাশিয়া থেকে দিল্লিতে পৌঁছেছেন। রাশিয়াই এখন পর্যন্ত একমাত্র দেশ, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার এত অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এতটা খারাপ হয়ে যাবে, আর একই সময়ে ভারত কাবুলের নতুন সরকারের সঙ্গে বহুপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তুলবে—এ তিন পক্ষের কেউই কল্পনা করেনি।
তালেবানবিরোধী ও পশ্চিমা–সমর্থিত যে আফগান সরকারকে ভারত একসময় সমর্থন দিত, সেই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তালেবান। তবু এ সফর দুই পক্ষের বাস্তববাদী কূটনীতি ও দূরদর্শিতা প্রকাশ করছে। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, দুই দেশই কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
এ সফরকে ভারতের আফগান নীতি জোরদার করার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করার পর নয়াদিল্লি ঘোষণা করেছে, তারা কাবুলে তাদের দূতাবাস আবার খুলবে।
আমির খান মুত্তাকি আফগান পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে গতকাল দিল্লিতে জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
মুত্তাকিকে জয়শঙ্কর বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আপনাদের জাতীয় উন্নয়ন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখবে।’ তিনি আফগানিস্তানের ‘সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষায় ভারতের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি’ পুনর্ব্যক্ত করেন।
অন্যদিকে মুত্তাকি ভারতকে ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন, এ সফর দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবে।
সফররত আফগান প্রতিনিধিদল ভারতের ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবে।
‘অপ্রত্যাশিত’ মিত্রের মধ্যে বোঝাপড়া
ভারত যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, তবু দেশটি তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক বা অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক রক্ষাকারী কয়েকটি দেশের অন্যতম। বর্তমানে ভারতের একটি ছোট প্রতিনিধিদল কাবুলে অবস্থান করছে এবং ভারত বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ আফগানিস্তানে নিয়মিত মানবিক সহায়তা পাঠায়।
ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে ইসলামপন্থী তালেবানের যোগাযোগ শুরু হয় কাবুলে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার কিছুদিন পর থেকেই।
আমির খান মুত্তাকির এ সফর এমন সময়ে হচ্ছে, যখন ভারত–পাকিস্তান সম্পর্ক যেমন খারাপ হচ্ছে, তেমন পাকিস্তান–তালেবান সম্পর্কও দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে।
ভারতের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’–এর হার্শ ভি পান্ত ও শিভম শেখাওয়াত এনডিটিভিকে বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় তালেবান এখন বিকল্প সম্পর্ক গড়ে তুলে দেখাতে চাইছে, তারা আর ইসলামাবাদের ওপর নির্ভরশীল নয়। পাকিস্তানের ওপর অতি নির্ভরশীলতার পরিচয় থেকে তারা নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরি করছে।’
কৌশলগতবিষয়ক বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, এ সফর ‘পাকিস্তানের জন্য একধরনের ধাক্কা’ এবং এটি তালেবান সরকারের কার্যত স্বীকৃতির দিকে একটি বড় পদক্ষেপ।
তালেবানবিরোধী ও পশ্চিমা–সমর্থিত যে আফগান সরকারকে ভারত একসময় সমর্থন দিত, সেই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তালেবান। তবু এ সফর দুই পক্ষের বাস্তববাদী কূটনীতি ও দূরদর্শিতা প্রকাশ করছে। এ থেকে স্পষ্ট, দুই দেশই কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে গুরুত্ব দিচ্ছে।
ব্রহ্ম চেলানি আরও বলেন, ‘এটি ভারত–তালেবান সম্পর্কের এক সতর্ক পুনর্গঠন; যেখানে দুই পক্ষই নিজেদের কৌশলগত স্বার্থে বাস্তববাদী যোগাযোগকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।’ এ সফর আফগানিস্তানের আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যেও এক সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
চার বছর আগেও এমন কিছু ঘটবে, তা ছিল কল্পনাতীত।
কাবুল পতনের পর ভারতের নীতি
২০২১ সালের মাঝামাঝি মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর আফগানিস্তান ছাড়ার সময়সূচি ঘোষণার পর ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ১৫ আগস্ট ২০২১ তালেবান কাবুল দখল করলে ভারত সেখানে তাদের দূতাবাস ও আফগানিস্তানে থাকা চারটি কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়। শিক্ষার্থী, রোগী, ব্যবসায়ী, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ—সব আফগানের ভিসা দেওয়াও বন্ধ করে দেয় দেশটি।
আবার নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কার কথা বলে মাত্র এক ক্লিকে প্রায় হাজারো আফগানকে এর আগে দেওয়া ভিসা বাতিল করে দেয় ভারত।
তবে এক বছরের মধ্যেই ভারত আবার আফগানিস্তানে তার কূটনৈতিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করে। ২০২২ সালের জুনে কাবুলে মানবিক সহায়তা বিতরণ কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে থাকা একটি ‘কারিগরি দল’ পাঠায় তারা।
এরপর ভারত তালেবান সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি, কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ভিসা দিতে শুরু করে। যদিও এসব সফর প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়নি, কিন্তু পারস্পরিক আস্থা ও বোঝাপড়া তৈরিতে সহায়তা করেছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় তালেবান এখন বিকল্প সম্পর্ক গড়ে তুলে দেখাতে চাইছে, তারা আর ইসলামাবাদের ওপর নির্ভরশীল নয়। পাকিস্তানের ওপর অতি নির্ভরশীলতার পরিচয় থেকে তারা নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরি করছে।
গত নভেম্বরে ভারত তালেবানকে দিল্লিতে একজন প্রতিনিধি নিয়োগ এবং পরে মুম্বাই ও হায়দরাবাদে কনস্যুলেট খোলার অনুমতি দিয়েছে।
গত তিন বছরেই দুই দেশের মধ্যে ধীরে ধীরে সম্পর্ক পুনর্গঠনের এ কাজ চলছে। এই সময়ের মধ্যে ভারতীয় কূটনীতিকেরা বিদেশে তালেবান নেতাদের সঙ্গে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুবাইয়ে মুত্তাকির সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির বৈঠক তারই অংশ ছিল।
প্রভাব বিস্তারের লড়াই
ভারত ও পাকিস্তান বহুদিন ধরে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এটি এমন এক লড়াই, যেখানে একজনের লাভ মানে অন্যজনের ক্ষতি।
তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ভারতীয় সামরিক ও রাজনৈতিক মহল ১৯৯৪ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তালেবানকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি বা প্রক্সি হিসেবে দেখত; যারা আফগানিস্তান থেকে ভারতকে সরিয়ে দিতে চায়।
রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে মিলে ভারত তখন তালেবানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিত। ২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগপর্যন্ত এ চেষ্টা অব্যাহত ছিল।
এরপরের ২০ বছর ভারত যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আফগান সরকারের অন্যতম প্রধান সমর্থক ছিল। তালেবানসহ অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠী দীর্ঘ এ সময়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী ও তাদের সহায়তাপুষ্ট আফগান সরকারি বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে যায়।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের প্রথম শাসনামল (১৯৯৬–২০০১) ও দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় ফেরার শুরুর দিকে সম্পর্ক ভালো থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা মারাত্মকভাবে খারাপ হয়েছে।
এখন সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা প্রকাশ্যে আফগানিস্তানকে ‘শত্রু দেশ’ বলে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তান অভিযোগ করছে, তালেবান সরকার পাকিস্তানি তালেবানকে (টিটিপি) আফগান ভূমি ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলার সুযোগ দিচ্ছে। এ অভিযোগে পাকিস্তান তার দাবি অনুযায়ী আফগান ভূখণ্ডে ‘টিটিপির ঘাঁটিতে’ বিমান হামলা চালিয়েছে।
তালেবান বারবার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং পাল্টা অভিযোগ করেছে, পাকিস্তানের কিছু গোষ্ঠী আফগানিস্তানকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ নিরাপত্তা, বিশেষত আইএস, আল–কায়েদা ও ভারতকেন্দ্রিক উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম। তালেবান নয়াদিল্লিকে আশ্বস্ত করেছে, তারা আফগান ভূখণ্ডকে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করতে দেবে না। গতকাল মুত্তাকিও সেই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক ভারতের জন্য কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। ইরান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে এবং ওই অঞ্চলে চীন ও পাকিস্তানের প্রভাব মোকাবিলায় এ সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে সম্পর্ক যতই গভীর হোক, দুই পক্ষই এখনো সতর্ক। অতীতের অভিজ্ঞতা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া—সবকিছুর কারণে তাদের সম্পর্ক এখনো কৌশলগত ও সীমিত পরিসরেই রয়ে গেছে।