অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ই জুলাই ২০২৫, ১১:৩১
জা উপত্যকা এখন এক জীবন্ত কবরস্তান। মাটি আর লাশ। এর বাইরে যেসব মানুষ বেঁচে আছেন তারা জীবন্মৃত। অর্থাৎ বেঁচে থেকেও তারা মৃত। তাদের দেহে শুধুই নিশ্বাস-প্রশ্বাস আসা যাওয়া করছে। তা ছাড়া তারা যেভাবে বেঁচে আছে একে মানুষের জীবন বলে না। তারা বেঁচে আছেন সন্তান, স্বামী, স্ত্রী, মা, বাবা, ভাইবোন- হারানোর বেদনা নিয়ে। অবিরাম বোমা হামলা আর গুলির আতঙ্ক নিয়ে। বেঁচে আছেন অনাহারে। তাদেরকে খাবারের লোভ দেখিয়ে পাখির মতো গুলি করে মারা হচ্ছে। বাড়িঘর মাটিতে মিশে গেছে। বসবাস এখন উত্তপ্ত মরুর বালুর ওপর তাঁবুতে। সেখানেও বেঁচে থাকার গ্যারান্টি নেই। তাঁবুতে, আশ্রয়কেন্দ্রে, বাফার জোন আখ্যা দেয়া স্থানগুলোতেও অবিরাম হামলা হচ্ছে। মানুষের যখন পেটে খাবার থাকে না, তখন সে হুঁশ হারিয়ে ফেলে। পেটকে কোনোমতে জামিন দেয়ার জন্য সে কী না করে!
তাকে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) কেন্দ্র থেকে খাবার দেয়ার লোভ দেখানো হচ্ছে। ক্ষুধায় কাতর মানুষ দিগ্বিদিক চিন্তাভাবনা না করে পঙ্গপালের মতো ছুটে যান সেখানে। আশা একটু খাবার হলে ঘরে ক্ষুধায় বেহুঁশ সন্তানের মুখে একটা রুটি তুলে দিতে পারবেন। কিন্তু খাবারের বিপরীতে তাদের কপালে জুটছে গুলি। সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে এসব মানুষকে। বিপরীতে বয়ান দেয়া হচ্ছে, ইসরাইলি বাহিনী হামাসের সদস্যদের উদ্দেশ্য করে গুলি ছুড়েছে। তারা হামাসের আশ্রয়স্থান লক্ষ্য করে হামলা করেছে। কিন্তু মিডিয়ার খবরে, আধুনিক ইন্টারনেটের যুগে জিএইচএফে দৌড়ে যাওয়া মানুষগুলোকে যারা দেখেছেন, তারা কি বলবেন ওইসব মানুষ হামাসের সদস্য? তারা ইসরাইলি বাহিনীর প্রতি হুমকি? তারা ইসরাইলি সেনাদের গুলি করতে গিয়েছে?
প্রায় সব টেলিভিশনে দেখানো দৃশ্যে দেখা গেছে, অনাহারী মানুষগুলো শুধুই একটু খাবারের জন্য হামলে পড়েছে। তারা প্রতিযোগিতায় কার আগে কে সাহায্য পাবেন, তাতে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছে। যদি বলা হতো শৃংখলা ফেরাতে গুলি করা হয়েছে, তাও কি মানানসই হতো? হতো না। কারণ, বিশৃংখল অবস্থায় শৃংখলা ফেরাতে হলে আপনাকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে হয়। সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে হয়। কিন্তু তা কী করা হয়েছে? উত্তর- না। উত্তর হলো সরাসরি মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে সেই কারবালার ময়দানের কথা মনে পড়ে যায়। কারবালার ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি ঘটে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে (১০ মুহাররম, ৬১ হিজরি), বর্তমান ইরাকের কারবালা নামক স্থানে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র (নাতি) ইমাম হুসাইন (আ.) ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক। উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ অত্যাচারী ও ধর্মবিরোধী শাসক হিসেবে পরিচিত ছিল। ইয়াজিদের পথ ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী।
ইমাম হুসাইন (আ.) পরিবার-পরিজন ও সাহাবিদের নিয়ে কুফাবাসীদের দাওয়াতে রওনা দেন। কিন্তু পথেই তাকে কারবালায় বাধা দেয়া হয়। সেখানে তাঁকে ও তাঁর পরিবারসহ ৭২ জন সঙ্গীকে পানি ও খাবার থেকে বঞ্চিত করে তিন দিন ঘোরতর পিপাসার মাঝে ফেলে রাখা হয়। ১০ই মুহাররম আশুরার দিনে ইয়াজিদের বিশাল বাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের ওপর আক্রমণ চালায়। একে একে তাঁর ভাই, সন্তান, আত্মীয় ও সঙ্গীরা শহীদ হন। শেষ পর্যন্ত ইমাম হুসাইন (আ.)-কেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর মাথা কেটে ফেলা হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনার মাধ্যমে ইমাম হুসাইন (আ.) ইসলাম, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের জন্য শহীদ হন। তাঁর আত্মত্যাগ আজও মুসলিম বিশ্বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।
গাজা পরিস্থিতি সেই কারবালা না হলেও ঠিক যেন তারই প্রতিফলন। কারবালার ময়দানে মুসলিমদেরকে পানি ও খাদ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। খাদ্য ও পানির অভাবে শিশুরা পিতা-মাতার জিহ্বা মুখে নিয়ে চুষে পানির তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করেছিল। গাজায় কী হচ্ছে? গাজায়ও খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, আন্তর্জাতিক সহায়তা, বিদেশি সাংবাদিকের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিরীহ মানুষকে গণহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে না এ যুগের নেতানিয়াহু? গাজায় ত্রাণ দিতে গিয়ে আটক করেছেন ফ্লোটিলা মেডলিনের গ্রেটা থানবার্গরা। মানুষ কি মানুষের সহায়তায় পাশে দাঁড়াবে না? কোন উদাহরণ সৃষ্টি করছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু? তার দেশের প্রভাবশালী পত্রিকা হারেৎজ বলছে, তিনি নিজের রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য গাজা ও ইরান যুদ্ধ শুরু করেছেন এবং তাকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব কী করছে? আর কবে মুসলিমদের ঘুম ভাঙবে? এরই মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়েছে। কারণ, ইসরাইল যা চায়, তা বাস্তবসম্মত নয়। তারা গাজার শতকরা ৪০ ভাগ অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে চায়। অর্থাৎ গাজার প্রায় অর্ধেক অংশে তাদের দখলদারিত্ব বজায় রাখতে চায়। ফলে ছোট্ট উপত্যাকা গাজার অস্তিত্ব বলতে কিছু থাকবে না।
এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ওমর রহমান বলেন, ইসরাইলের লক্ষ্য শুধু হামাস নয়, বরং গাজার পূর্ণ কাঠামোগত ধ্বংস, ফিলিস্তিনি সমাজের কাঠামোগত পতন এবং গাজা উপত্যকা থেকে জনসংখ্যাকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করা। তিনি বলেন, জিএইচএফের মতো প্রকল্প আসলে ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল মিলে তৈরি করেছে, যাতে সাহায্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে ফিলিস্তিনিদের এক জায়গায় গাদাগাদি করে রাখা যায়। ইসরাইলের তথাকথিত ‘মানবিক শহর’ পরিকল্পনা আদতে একটি ‘ঘন জনাকীর্ণ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ হবে। সেখান থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে পরবর্তীতে ফিলিস্তিনিদের বহিষ্কার করা হবে। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ইতিহাসবিদ লোরেঞ্জো কামেল বলেন, ১৯৪৮ সালে লিদ্দা গ্রাম থেকে ৭০ হাজার ফিলিস্তিনিকে জোর করে উৎখাত করা হয়েছিল। অনেকেই পরে গাজায় এসে আশ্রয় নেয়। তার মতে, রাফাহ ধ্বংস করে গাজার জনগণকে একত্র করার পরিকল্পনা আসলে আরেকটি জাতিগত উৎখাতের প্রস্তুতি মাত্র।